সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ফিরেছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা
সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাস পর চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ফিরেছেন এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিকরা। অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের জড়িয়ে ধরে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে কাঁদলেন কেউ কেউ। জানালেন বন্দিদশার দুর্বিষহ দিনগুলোর স্মৃতি। বললেন, নতুন জীবন পাওয়ার কথা।
জাহাজ থেকে নামার পর মঙ্গলবার (১৪ মে) বিকালে জিম্মিদশার তিক্ততার কথা জানিয়েছেন আবদুল্লাহর সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেছেন, ‘জিম্মি অবস্থায়ও আমরা মনোবল হারাইনি। মনে করেছিলাম, তিন-চার মাস লেগে যেতে পারে। তবে এক মাসের মধ্যে মুক্তি পাবো, কখনও ভাবিনি। আমাদের ছাড়ানোর জন্য মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে। একটি এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে এই মুক্তিপণের টাকা দেওয়া হয়েছিল। আমরা দেখেছি, কিন্তু কত টাকা দেওয়া হয়েছে, তা জানি না। মুক্তিপণ পাওয়ার পর দস্যুরা আমাদের ছেড়ে দিয়েছে। কেএসআরএম মালিকপক্ষের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতার কারণে খুব তাড়াতাড়ি মুক্ত হতে পেরেছি।’
বীভৎস দিনগুলোর স্মৃতি জানিয়ে জাহাজে ওয়েলার পদে কর্মরত মো. শামসুদ্দিন বলেন, ‘জিম্মি দশার ৩৩ দিন বড় ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যে ছিলাম। একেকটা দিন আতঙ্কের মধ্য দিয়ে পার করেছি। মনে করেছিলাম, দেশে আর আমাদের ফেরা হবে না। এখানেই বুঝি আমরা শেষ। দুস্যুরা অনেক সময় আমাদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে। মনে হতো এই বুঝি আমাকে গুলি করলো। বন্দুকের নল দিয়ে গুতা দিতে চাইতো। তবে বড় ধরনের নির্যাতন করেনি। সবসময় ৫০-৬০ জন দস্যু আমাদের পাহারায় ছিল।’
কীভাবে স্বজনদের কাছে ফিরবো, কখন মুক্ত হওয়ার সংবাদ শুনবো এই অপেক্ষায় প্রতিটি দিন কেটে জানিয়ে শামসুদ্দিন বলেন, ‘আমাদের খাবার সংকট ছিল না। পর্যাপ্ত খাবার মজুত ছিল। তবে গোসল আর খাবার পানির কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। সবাই কখন মুক্ত হবো, এই চিন্তায় মগ্ন ছিলাম সবসময়।’
যেদিন আমাদের জিম্মি করেছিল সেদিন মানসিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল উল্লেখ করে জাহাজের নাবিক মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘দস্যুরা আমাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করে এমনটাই ভাবনা ছিল। বন্দি থাকা অবস্থায় সবসময় চাইলেও পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না। দস্যুরা সপ্তাহে একবার করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কথা বলার সুযোগ দিতো। বন্দি থাকা অবস্থায় ঈদ করেছি। তখন ঈদ মনে হয়নি। আজকে আমাদের ঈদ মনে হচ্ছে। এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।’
জাহাজটির আরেক নাবিক মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক বলেন, ‘ঈদের দিন শুধুমাত্র সবাইকে একসঙ্গে নামাজ পড়ার অনুমতি দিয়েছিল দস্যুরা। আমরা শুধুমাত্র নামাজ আদায় করেছি। এটুকুই ছিল আমাদের ঈদ। নামাজ পড়া অবস্থায়ও দস্যুরা চারপাশে অস্ত্র তাক করে রেখেছিল। ঈদের দিন আমরা একটুকু শুনেছিলাম, দস্যুদের সঙ্গে আমাদের মালিকপক্ষ কথা বলেছেন। শিগগিরই মুক্তি পাবো। মুক্তিপণের বিনিময়ে আমরা ছাড়া পেয়েছি। তবে কী পরিমাণ টাকা দেওয়া হয়েছে, তা জানা নেই। এয়ারক্রাফটে টাকা দেওয়া হয়েছিল, এটা দেখেছি।’
মঙ্গলবার বিকালে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে ফিরেছেন এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিক। তারা এমভি জাহান মণি-৩ লাইটার জাহাজে করে এসেছেন। এর আগে বঙ্গোপসাগরের কুতুবদিয়ায় এমভি আবদুল্লাহ থেকে নেমে জাহান মণিতে ওঠেন। তাদের নিয়ে জাহাজটি বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল জেটিতে ভিড়ে। বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে নাবিকরা একে একে জাহাজ থেকে নেমে আসেন। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং জাহাজ মালিকপক্ষ কেএসআরএম তাদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। টার্মিনাল জেটি চত্বরে তাদের জন্য সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
জিম্মি হওয়ার পর এমন দিন জীবনে আসবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় ছিল উল্লেখ করে আতিক উল্লাহ খান বলেন, ‘৩৩ দিন জিম্মি ছিলাম। একেকটা দিন একেকভাবে কেটেছে। মনে হয়েছে, কয়েক বছর। প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে দস্যুরা খারাপ আচরণ করলেও পরের দিনগুলোতে আচরণ পরিবর্তন হয়েছে। তবে সবসময় আমাদের চোখে চোখে রাখতো। মাথার ওপর অস্ত্র তাক করা থাকতো। এমনকি ঘুমাতে গেলেও মাথার ওপর অস্ত্র ধরে রাখতো। তাদের কাছে এমন সব ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল, যা আমি জীবনে কমই দেখেছি।’
নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে জাহাজের ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুর রশিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অক্ষত অবস্থায় ফেরত এসেছি। অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে, বলে প্রকাশ করা যাবে না। তবে সবাই জীবিত ফিরতে পারবো কিনা, তা নিয়ে সংশয় ছিল। জিম্মিদশার ৩৩ দিন আমরা অনেক স্ট্রং ছিলাম। এখন দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি। এই জীবনের জন্য দেশবাসীর ভালোবাসা ছিল। কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টা ছিল। সবার সহযোগিতায় সুস্থভাবে দেশে ফিরতে পেরেছি।’
নাবিকদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পর কেএসআরএম গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২৩ নাবিককে সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে আনাই ছিল আমাদের মূল লক্ষ্য। নাবিকরা সুস্থভাবে দেশে ফিরেছেন। এটাই ছিল আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা। এই প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। জিম্মিদশা অবস্থায় নাবিকরা মনোবল হারাননি। বলা যায় তারা অনেক সাহসী ছিলেন।’
এর আগেও আমাদের জাহাজ এমভি জাহান মণি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল উল্লেখ করে শাহরিয়ার জাহান বলেন, ‘তখন ৯৯ দিন পর নাবিকদের অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ওই বারের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এবার এক মাসের মধ্যে নাবিকদের দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করতে পেরেছি আমরা।’
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ কেএসআরএম গ্রুপের এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন। এসআর শিপিং সূত্র জানিয়েছে, গত ৪ মার্চ আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে কয়লা নিয়ে যাত্রা করে জাহাজটি। ১৯ মার্চ সংযুক্ত আরব আমিরাতের হারমিয়া বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগর থেকে এটি ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার দস্যুরা। জলদস্যুদের হাতে জিম্মির খবরে নাবিকদের পরিবারে নেমে আসে দুশ্চিন্তা। উৎকণ্ঠায় ছিলেন স্বজনরা।
শেষ পর্যন্ত মুক্তিপণ দিয়ে ১৩ এপ্রিল দিবাগত রাতে জাহাজটি মুক্ত করা হয়। মুক্তির পর আমিরাতের উদ্দেশে রওনা দেয়। ২১ এপ্রিল আমিরাতের আল হারমিয়া বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে। এতে থাকা ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লা সেখানে খালাস করা হয়। পরে আমিরাতের মিনা সাকার বন্দর থেকে ৫৬ হাজার টন চুনাপাথর লোড করা হয়। এসব পাথর নিয়ে দেশের পথে রওনা দেয়। সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপকূলে নোঙর করেছিল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন