নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে স্বামী আবুল কাশেমের মৃত্যুতে স্ত্রীর আহাজারি। ছবি: স্টার
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে র্যাবের সঙ্গে 'বন্দুকযুদ্ধে' আবুল কাশেম নামে ষাটোর্ধ্ব একজন নিহত হয়েছেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হুমায়ূন কবির (৫০) নামে আরেক ব্যক্তি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গতকাল রাত সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলার সাদিপুর ইউনিয়নের বরগাঁ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে বলে জানান জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল।
পুলিশ জানায়, নিহত আবুল কাশেম (৬৫) ওই এলাকার প্রয়াত কদম আলীর ছেলে৷ আহত হুমায়ূন কবির একই এলাকার প্রয়াত ছদরুদ্দিন ভূঁইয়ার ছেলে।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, গতরাতে গ্রামে ডাকাত পড়েছে শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলে সাদাপোশাকে র্যাব সদস্যরা তাদের গুলি করে।
সোনারগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আহসান উল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নিহতের পেটে গুলির আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ঘটনা কী ঘটেছে তা বিস্তারিত র্যাব বলতে পারবে। আমরা ভোরে খবর পেয়ে হাসপাতালে এসেছি।'
সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন সিজান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাত ৩টা ১০মিনিটে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ওই বৃদ্ধকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন৷ তাকে পরীক্ষা করে জানা যায়, আগেই তার মৃত্যু হয়েছে৷ তার নাভির উপরে একটি বুলেটের চিহ্ন আছে।'
আহত হুমায়ূন কবির গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে নিশ্চিত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। তিনি জানান, স্বজনরাই তাকে রাতে হাসপাতালে ভর্তি করে।
জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, 'জানতে পেরেছি, শুক্রবার দিবাগত রাত আনুমানিক সাড়ে ১২টার দিকে সোনারগাঁওয়ে র্যাব-১১ এর একটি দল আসামি গ্রেপ্তারের জন্য যায়৷ আসামি গ্রেপ্তার করে ফেরার পথে কিছু দুষ্কৃতিকারী আসামিকে ছিনিয়ে নিতে র্যাবের ওপর আক্রমণ করলে র্যাব সদস্যরা আহত হন। র্যাবের উপরে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে বলেও জানতে পেরেছি৷ আত্মরক্ষার্থে র্যাব সদস্যরা পাল্টা গুলি করলে তাদের মধ্যে একটা সংঘর্ষ হয়।'
এ ঘটনায় মামলার আইনি ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে।
পরিবারের অভিযোগ
নিহতের স্ত্রী রমিজা বেগম জানান, আবুল কাশেম পেশায় একজন বাঁশ ও বেতের হস্তশিল্পী। তার পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারকে রমিজা বলেন, শনিবার রাতে তিনি ও তার বাড়ির পাশে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পান৷ এসময় একদল লোক তাদের পরিচিত গার্মেন্টস শ্রমিক সেলিমকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলে দেখতে পান৷ এ সময় সেলিম কাঁদতে থাকেন৷ শার্ট ও গেঞ্জি পরা লোকজন র্যাবের সদস্য তা তারা জানতেন না৷ তারা ভেবেছিলেন সন্ত্রাসী কেউ বা গ্রামে ডাকাত পড়েছে৷
'আমার স্বামী এইটা দেইখা সামনে গিয়া কেন সেলিমরে ধইরা নিতাছে তা জানতে চায়৷ পরে সাদাপোশাকের লোকজন লাঠি দিয়া আমার স্বামীরে মারে৷ তখন হ্যায় চিৎকার দিয়ে যারা মারছেন তাগোরে গালাগালি করতে থাকলে একজন নিজেদের র্যাব পরিচয় দিয়া পেটের মধ্যে গুলি করে,' বলেন রমিজা।
এর ঘটনার পর রাতে পুলিশ ও র্যাব সদস্যরা আবুল কাশেমের ছেলে জামদানি কারিগর নজরুল ইসলাম (৪০) ও তার দশম শ্রেণি পড়ুয়া ছেলে শ্রাবণ ইসলাম (১৭)কে ধরে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ করেছেন নজরুলের স্ত্রী আমিনা আক্তার।
অন্যদিকে আহত হুমায়ূন কবিরের স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, হুমায়ূন কবিরের স্থানীয় বাজারে একটি ওষুধের দোকান আছে৷ রাতে গুলির শব্দ পেয়ে ঘর থেকে বের হন৷ ওই সময় হৈ-চৈ দেখে এগিয়ে গেলে তিনি গুলিবিদ্ধ হন৷ তার বা পায়ে দুইটা এবং ডান পায়ে একটা গুলি লেগেছে৷ তিনি মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন৷
'প্রথমে তো বোঝে নাই যে তারা ডিবি না র্যাবের সদস্য৷ ওইটা জানলে তো আর যাইতো না৷ র্যাব নাকি সেলিমরে একটা মার্ডার মামলায় ধরতে আইছিল৷ লোকজন ভাবছে ডাকাইত পড়ছে গ্রামে৷ ছয়-সাতটা গুলি চলছে৷ র্যাব মাইরা থুইয়া যাবার পর একটা মোটরসাইকেল সেইখানে পইড়া ছিল৷ ওই মোটরসাইকেল নিতে পরে রাত দুইটার পর চাইর-পাঁচটা গাড়িভর্তি পুলিশ আসে৷ তারা কয়েকটা ঘর ভাঙচুর কইরা গ্রামের অন্তত ২২ জনরে ধইরা নিয়া যায়৷'
২২ জনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সোনারগাঁও থানার পরিদর্শক আহসান উল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ কাউকে আটক করেনি৷ ওইখানে র্যাবের অভিযান ছিল, পুলিশ কিছু করেনি৷'
র্যাবের বক্তব্য
এ বিষয়ে র্যাব-১১ এর অধিনায়ক ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত শুক্রবার সোনারগাঁওয়ে এক নারীর লাশ পাওয়া গিয়েছিল৷ সেই হত্যাকারীকে আমরা শনাক্ত করি এবং সেই আসামি সেলিমকে ধরতেই সোনারগাঁয়ের বরগাঁ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে র্যাব৷ আমরা আসামিকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার সময় কিছু দুষ্কৃতকারী আসামিকে ছিনিয়ে নিতে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে র্যাবের ওপর হামলা করে, গুলি করে৷ তখন আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি ছুড়ে আসামিকে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসে র্যাব। ওই সময় কেউ হতাহত হয়েছেন কিনা আমরা জানি না৷ পরে সকালে নিউজ পেয়েছি একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং একজন আহত আছেন৷
র্যাব কর্মকর্তা দাবি করেন, 'আমাদের চার জন সদস্য আহত আছেন৷ তাদের মধ্যে দু'জনের অবস্থা গুরুতর৷ তবে তারা গুলিবিদ্ধ নন, তাদের একজনের মাথার খুলিতে ক্ষত হয়েছে৷ তাকে পিলখানা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।'
র্যাব অভিযানে গিয়ে তাদের পরিচয় জানায়নি –এই প্রশ্ন করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, র্যাব পরিচয় দেয়নি এটা আসামিদের এক্সকিউজ৷ আমাদের পরে ডিবি ও জেলা পুলিশও গিয়েছিল৷ সবাই জানে এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হত্যা মামলার আসামিকে ধরতে গিয়েছিল৷ তাকে ছিনিয়ে নিতেই স্বজনরা আমাদের উপর হামলা করেন৷
নিহতের ছেলে ও নাতিসহ ২২ জনকে আটকের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে র্যাব কর্মকর্তা বলেন, যেহেতু র্যাবের ওপর হামলা হয়েছে সেহেতু আমরা পরে হামলাকারীদের কয়েকজনকে শনাক্ত করতে পেরে তাদের আটক করে নিয়ে এসেছি৷ তবে ২০ জনই অ্যারেস্টেড না৷ আমরা যাদের কনফার্ম করতে পেরেছি তাদের অ্যারেস্ট করা হবে৷ জিজ্ঞাসাবাদ ও যাচাই-বাছাই চলছে৷ সন্ধ্যা নাগাদ যখন মামলা হবে তখন নিশ্চিত করে অ্যারেস্টের সংখ্যা বলতে পারব৷'
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন