দালালের খপ্পরে পড়ে চাকরির প্রলোভনে গত বছর ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন ঢাকার মিরপুরের বাসিন্দা রবিন খান। চাকরি তো দূরের কথা উল্টো রবিনকে আটকে রেখে বিক্রি করে দেয়া হয় তার একটি কিডনি।
সম্প্রতি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সংবাদ সম্মেলনে উঠে আসে রবিনের (৩৫) জীবনের এমন মর্মান্তিক ঘটনা। রবিন যখন জানতে পারেন দালাদের এই চক্রটি রাজধানীর অনেক মানুষকে একইভাবে প্রতারিত করে আসছে তখন তিনি এই চক্রের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে চক্রটি শুধু দেশে না সংঘবদ্ধ জাল বিস্তার করেছে দেশের বাইরেও। কালোবাজারে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির চক্রগুলোর যোগসাজশ আন্তঃদেশীয় পর্যায়ে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে এশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গড়ে উঠেছে এমন সব কালোবাজারি চক্র, যাদের মূল কাজ মানুষ পাচার করে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে দেয়া।
ডিএমপির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমান বাজারে বিশেষ করে এশীয় অঞ্চলে এক একটি কিডনির দাম ২৫ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা। যেখানে একটি কিডনির দাম এত তখন প্রশ্ন জাগে মানুষের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দাম কেমন এবং কালোবাজারে কিডনির পাশাপাশি আর কী কী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়।
দ্য মেডিকেল ফিউচারিস্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ড. বারতালান মেস্কোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কালোবাজারে একজন মানুষের শরীর থেকে মোট ৪৫ মিলিয়ন ডলারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা সম্ভব, যা বাংলাদেশি মুদ্রার অর্থমূল্যে ৫০০ কোটি টাকার ওপরে।
সরাসরি কোনো মানুষ বৈধভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করতে না পারলেও কালোবাজারে সহজেই নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করতে পারেন। তবে ইন্টারনেটের ডার্ক ওয়েবের মতো বিস্তৃত এ কালোবাজারে সাধারণ মানুষের পদচারণা নেই বললেই চলে। এখানে মূলত সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে চলছে রমরমা অবৈধ ব্যবসা।
অর্থনৈতিক গবেষণা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওডিআইএফের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু কিডনি না, মানুষের হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, যকৃৎ, ক্ষুদ্রান্ত, এমনকি চামড়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কালোবাজারে বিক্রি হয়ে থাকে।
ওডিআইএফের গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি অবৈধ হলেও চাহিদার কারণে কালোবাজারে বাড়ছে এ ধরনের বেচাকেনা। শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিবছর ১ লাখ মানুষের হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়, যাদের অর্ধেক মারা যান প্রতিস্থাপনের জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অভাবে।
এই বিশাল চাহিদাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিবছর ২০ লাখ বিভিন্ন ধরনের মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয় মানবদেহের অস্থিমজ্জা বা বোন ম্যারো। কালোবাজারে প্রতি গ্রাম বোন ম্যারোর দাম ২৩ হাজার ডলার।
মেডিকেল ফিউচারিস্টের হিসাব অনুযায়ী, কালোবাজারে মানুষের প্রতিটি হৃৎপিণ্ডের দাম ১০ লাখ ডলার। হৃৎপিণ্ডের পর সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয় যকৃৎ। প্রতিটি যকৃতের দাম প্রায় সাড়ে ৫ লাখ ডলার। মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রির তালিকায় চাহিদার শীর্ষে কিডনির দাম। কালোবাজারে প্রতি পিস কিডনি বিক্রি হয় আড়াই লাখ ডলারের বেশি দামে।
শুধু প্রতিস্থাপনের উদ্দেশ্যেই কালোবাজারে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয় না। গবেষণার অনেক কাজে মানুষের চামড়া-চুল থেকে শুরু করে মগজ পর্যন্ত বিক্রি হয়।
যুক্তরাষ্ট্রেরভিত্তিক সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ব বিখ্যাত হার্ভাড মেডিকেল কলেজের পরীক্ষাগারে মানবদেহের যেসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে গবেষণা করা হয়, তার বড় একটি অংশ আসে কালোবাজারিদের হাত ধরে।
প্রতিবেদনে সেড্রিক লজ নামে এক ব্যক্তির তথ্য উঠে এসেছে, যিনি এ ধরনের অবৈধ কাজের সঙ্গে জড়িত এবং বর্তমানে জেলে আছেন। সেড্রিক লজ বহুদিন ধরে হার্ভাডের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে কালোবাজারির মাধ্যমে মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করে আসছিল। সেড্রিকের মতো অনেকের হাত ধরে কালোবাজারে দিনকে দিন এমন এক একটি দালাল চক্র গড়ে উঠেছে, যাদের হাত থেকে জীবিত ও মৃত কোনো মানুষই রেহাই পায় না।
এক দশক আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ঘণ্টায় কালোবাজারে একটি করে কিডনি পাচার হয়। শুধু কিডনির ওপর ভিত্তি করেই অবৈধ এ বাজারের সংখ্যা বেড়ে ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে এশীয় অঞ্চলগুলোতে কালোবাজারের মাধ্যমে কিডনি বেচাকেনা রমরমা অবস্থা ধারণ করেছে।
ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মতো দেশে অনেকেই কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য যান। এসব দেশে প্রতিস্থাপিত কিডনির বড় একটি অংশ আসে কালোবাজারিদের হাত ধরে, যার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশের রবিনের মর্মান্তিক ঘটনায়।
ডিএমপির ক্রাইম এবং অপারেশন বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মহিদ উদ্দিন জানান, কলকাতা, দিল্লি ও গুজরাট কেন্দ্রিক কিডনি পাচারের একটি সংঘবদ্ধ চক্র সক্রিয় আছে যাদের বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ বিদ্যমান। এরা দেশের নিম্নবিত্ত মানুষকে টার্গেট করে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে গিয়ে কিডনি বিক্রি করতে বাধ্য করে।
রবিনের বরাত দিয়ে মহিদ উদ্দিন জানান, কিডনি বিক্রি করে রবিন পেয়েছে মাত্র ৪ লাখ টাকা, যেখানে কিডনির সর্বনিম্ন বাজারমূল্য ২৫ লাখ টাকা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিডনি ১ কোটি টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। শুধু একটি কিডনি বিক্রি করে পাচারকারীরা ১৫ লাখ থেকে ৮০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করে।
শুধু বাংলাদেশ না, মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারের হটস্পট হিসেবে বারবার উঠে এসেছে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের নাম।
সংবাদসংস্থা রয়টার্স ফ্যাক্টবক্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার হয় চীনে। প্রতিবছর দেশটিতে ২০ লাখ মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপন করার প্রয়োজন পড়ে, যেখানে বৈধপথে কিডনি পাওয়া যায় মাত্র ২০ হাজার। এ বিপুল সংখ্যক কিডনির চাহিদা পুরোটাই কালোবাজারের মাধ্যমে মেটানো হয়।
চীনের পর কিডনি পাচারে উঠে এসেছে পাকিস্তানের নাম। এরসঙ্গে প্রতিবছরই কলম্বিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতে কিডনি পাচারের বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসছে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের পাঞ্জাবে কিডনি পাচারের সঙ্গে জড়িত ফাওয়াদ মুখতার নামে এক চিকিৎসকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুখতার একাই ৩২৮ জনকে অপারেশন করে কালোবাজারে কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন। মুখতারের ভাষ্যমতে তিনি প্রতিটি কিডনি ১ কোটি রুপিতে কালোবাজারে বিক্রি করেছেন বলে সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
হাসপাতাল বা ডাক্তারদের কিডনি পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনা বাংলাদেশের বেলায়ও ঘটেছে। বিশেষ করে রবিনের বেলায় পাচারকারীরা তাকে নিয়ে যে গুজরাটের হাসপাতালে অপারেশন করিয়েছেন বা বাংলাদেশের একটি ডায়গনেস্টিক সেন্টারে তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছেন; দুইক্ষেত্রেও এসব প্রতিষ্ঠান কিডনি পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত কিনা তা নিয়ে তদন্ত করছে ডিএমপি।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের কলকাতা, বনগাঁ, বারাসাত, দিল্লি, জয়পুর, গুরগাঁও ও ফরিদাবাদ এবং বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জে কিডনি পাচারের সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে উঠেছে; যারা আন্তঃদেশীয় যোগাযোগের মাধ্যমে দেদারসে মানবদেহের এ মূল্যবান অঙ্গটি পাচার করছে।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের তদন্ত থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ৪৫ জনের একটি চক্র নিয়মিত ভারতে যাতায়াত করে, যাদের মূল লক্ষ্য সমাজের নিম্নবিত্ত মানুষদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে ভারত নিয়ে গিয়ে কিডনি বিক্রিতে বাধ্য করা।ৎ
ভারতের মেডিকেল ট্যুরিজম ভিসা সুবিধা কাজে লাগিয়ে এ চক্রটি সাধারণ মানুষদের ভারত নিয়ে গিয়ে কিডনি বিক্রি করে দেয়। এ পুরো চক্রটির সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের হাসপাতাল, ডাক্তার, দালাল ও রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিও জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন ভারতীয় গোয়েন্দারা।
এশিয়া প্যাসিফিক জার্নালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বে অভিবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বাড়ছে মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারের সংখ্যা। অনেক মানুষ উন্নত জীবনের আশায় বিদেশ পাড়ি জমিয়ে পাচারচক্রের খপ্পরে নিজের মূল্যবান অঙ্গ থেকে শুরু করে জীবন পর্যন্ত হারাচ্ছেন।
তবে এ নিয়ে নেই কোনো উল্লেখযোগ্য গবেষণা। প্রতিবছর যে পরিমাণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচার হয় তার মাত্র ২ শতাংশ উঠে আসে নানা গবেষণা ও সংবাদ প্রতিবেদনে। এতে করে বছরান্তে মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারের পরিমাণ বাড়লেও মিলছে না কোনো প্রতিকার।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন