জসিম উদ্দিন
সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ দুর্দশায় রয়েছে। জাতিকে প্রতারিত করার একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে এর ব্যবহার হচ্ছে। একটি শ্রেণী ধূর্ততার সাথে এর ফায়দা লুটছে। ফায়দা নেয়া মানুষের মধ্যে রয়েছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং সংখ্যালঘুদের কথিত প্রতিনিধিত্বকারী চক্র। এ দুই শ্রেণী অত্যন্ত কৌশলে এর প্রয়োগ করে রাজনৈতিক ও কায়েমি স্বার্থ হাসিল করছে। অন্য দিকে, দুর্বল সংখ্যালঘু শ্রেণী ক্রমাগত জমিজিরাত হারাচ্ছে, ক্ষেত্রবিশেষে নিজেদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হচ্ছেন।
পুলিশের সাবেক আইজি বেনজীরের কীর্তিকলাপ অনুসন্ধানে বিষয়টি বোঝা যায়। তিনি গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুরে যে ৬০০ বিঘা জমি হাতিয়ে নিয়েছেন তার বেশির ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের। সংখ্যালঘুদের কমজোরিকে নিশানা করে অঢেল জমি নিজের নামে বাগিয়ে নিয়েছেন। এতে তিনি র্যাব-পুলিশসহ রাষ্ট্রযন্ত্র সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছেন। প্রথম আলো এক প্রতিবেদনে সরেজমিন ভুক্তভোগীদের অবস্থান তুলে ধরেছে।
পত্রিকাটি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বড়খোলা গ্রামের সরস্বতী রায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন তিনি কেন জমি বিক্রি করেছেন। উত্তর দেয়ার বদলে তিনি বিলাপ শুরু করেন। শেষে নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বলেন, ‘কত কষ্ট হইরা, সুদে টাহা নিয়া জমিটুকু (৩১ শতাংশ) কিনছিলাম। হেই জমিটুকু দিয়া আসা নাগছে।’ প্রথম আলোর সাথে সরস্বতীর কথোপকথনে বোঝা গেল এই বিধবা একেবারে নিরীহ ক্ষমতাহীন প্রান্তিক মানুষ। ক্ষমতার অপব্যবহারে ইতোমধ্যে বেনজীর বেকায়দায় পড়েছেন তা-ও তিনি সম্ভবত জানেন না। বেনজীরের ব্যাপারে তার জানাশোনা হচ্ছে ‘বড় পুলিশ’। বসতবাড়ির ৫ শতাংশ ছাড়া ভদ্রমহিলার এতটুকুই মোটের ওপর জমি ছিল। এ জমির ফসল দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলত, সেটা কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার ছেলে রঞ্জন রায় এখন দিনমজুর। সেখানে পাওয়া যায় এ ধরনের আরো কিছু হিন্দু পরিবার তারা সম্পদের সবটুকু জমি বিক্রি করতে বাধ্য হন।
সংখ্যালঘুদের জমি কেড়ে নিতে বেনজীর একটি চক্র গড়ে তোলেন। এ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধকে কূটকৌশলে তিনি বা তার চক্র ব্যবহার করেন। এর মধ্যে ১৪২ শতাংশ জমির মালিক প্রণবের পরিবার। তিনি জানান, জমি নিয়ে ভাইদের মধ্যে বিরোধ ছিল। বাকি দুই ভাইকে মৃত ও ওয়ারিশহীন দেখিয়ে তার কাছ থেকে দলিল করে নেয়া হয়। এ দলিলে শুধু প্রণবের স্বাক্ষর নেয়া হয়। ভুয়া দলিল করার সময় প্রণবকে হুমকি দেয়া হয় বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদের। তিনি বাধ্য হয়ে এ অবৈধ কাজে সায় দেন।
বেনজীর, তার স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে রিসোর্টসহ সবচেয়ে বেশি ৫৯৮ বিঘা জমি পাওয়া গেছে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা ও মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। এ দুই উপজেলা পাশাপাশি এবং বেনজীরের জমিও দুই উপজেলার সীমান্তঘেঁষা। এগুলো হিন্দু অধ্যুষিত। বেনজীর অঢেল সম্পদ হাতাতে এ এলাকাকে নিশানা করেন। এর কারণ হচ্ছে দুর্বলদের করায়ত্ত করা, যারা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন না। পত্রিকাটি আরেক তরুণ সঞ্জয় বলকে খুঁজে পায়। তিনি জানান, তার পরিবারের ৩০ বিঘার বেশি জমি জোর করে কিনে নিয়েছে বেনজীর চক্র। ২০১৮ ও ২০১৯ সালে র্যাবে থাকার সময় এ বেচাকেনা হয়। বড়খোলা গ্রামের প্রশান্ত দত্ত জানান, তারা সচ্ছল লোক, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমি বিক্রির কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিন ভাই মোট ২৪ বিঘা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। বেনজীরের রিসোর্টটি পড়েছে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৈরাগীরটোলায়। পত্রিকাটি এ এলাকার ২৭ জনের সঙ্গে কথা বলেছে। তাদের ২৫ জন বলেছেন, তারা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন।
ফসলের জমি, মাছের ঘের ও রিসোর্ট ঘিরে পুরো এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন বেনজীর। সেখানে পুলিশ র্যাব গোয়েন্দা বাহিনীর বলয় তৈরি করে রীতিমতো এক মাফিয়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। সংখ্যালঘুদের তটস্থ করে রাখা হতো সব সময়। তার খামারে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান সুখ দেব নামে একজন। ভয়ভীতি দেখিয়ে তার পরিবারকে আইনি ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত রাখা হয়। তার মাছের ঘেরে মাছ ধরার অপরাধে সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
হিন্দুদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নেয়ার সময়কালটি ছিল বেনজীরের ডিএমপি কমিশনার হওয়ার পর থেকে। সেটা তার ক্ষমতার একেবারে শীর্ষ পদে বহাল হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নামে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যদিও তাদের কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তারা যখন মুসলমানদের লক্ষ্য করে প্রতিক্রিয়া জানান, প্রায় সেটা সীমা ছাড়িয়ে যায়। ভাগ্য ভালো এ দেশের মুসলমানরা সহনশীল কিংবা তারা এ পরিষদকে ভয় পায়। তাই তাদের ব্যাপারে কিছু করা দূরে থাক; প্রতিবাদ করা থেকেও নিবৃত্ত থাকে।
এটা অত্যন্ত রহস্যজনক ব্যাপার যে, এভাবে অসংখ্য হিন্দু পরিবারকে জোরপূর্বক জমি দিয়ে দিতে বাধ্য করা হচ্ছে তা এ পরিষদ জানবে না। তারা নিশ্চয় এ ব্যাপারে জানত। বেশ কয়েক ডজন সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্য জমি হারিয়েছেন। তাদের কেউ না কেউ অভিযোগ নিয়ে এ সংগঠনের কাছে অবশ্যই গিয়েছেন। নিরুপায় ধর্মীয় ভাইদের পক্ষে দাঁড়ানোর কোনো তাগিদ তারা বোধ করেননি। ধরে নিলাম ভুক্তভোগীরা তাদের কাছে যাননি। এখনতো বিষয়টি মিডিয়ার মাধ্যমে সারা দেশে প্রকাশ হয়ে গেছে। এখনো কেন বিষয়টি নিয়ে তারা শোরগোল তুলছেন না। তারা কেন বলছেন না, সংখ্যালঘুদের জমি ফেরত দিতে হবে। এটা তারা করছেন না এ জন্য যে, তারা এতে নিজেদের কোনো লাভ দেখেন না।
এর পেছনের কারণটি তাদের আগের ক্রিয়াকর্মের মধ্যেও টের পাওয়া যায়। মূলত ক্ষমতাহীন সংখ্যালঘুদের জন্য এরা কখনো প্রতিকার এনে দেন না। সে জন্য এরা কখনো আন্তরিক হয়ে কাজ করেছেন তা-ও দেখা যায় না। সারা দেশে বর্তমান সরকারের আমলে বহু সংখ্যালঘু পীড়নের নানামাত্রিক ঘটনা ঘটেছে। এগুলো সব ঘটিয়েছেন বর্তমান ক্ষমতাসীনরা। এগুলোর ব্যাপারে কথিত সংখ্যালঘুদের সংগঠন সেভাবে সোচ্চার হয়নি। এ ক্ষেত্রে তারা সংখ্যালঘুদের চেয়েও ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ রক্ষায় বেশি মনোযোগ দেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনে তাদের এ প্রতারণামূলক আচরণ ভালো করে প্রকাশ পেয়ে গেছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের হয়ে গলা চড়ানো একটি লাভজনক বিষয়। এতে করে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ও নানা ধরনের নগদ প্রাপ্তি ঘটে। এদের একটি অভিজাত শ্রেণীরও বিকাশ হয়েছে বাংলাদেশে। কেবল সংখ্যালঘু হওয়ায় দেশের নাগরিক সমাজ ও প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ে এসব অভিজাত জায়গা করে নিচ্ছেন। বিশেষ করে প্রশাসন ও পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের নামে গলা চড়ানো আর সরকারের বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিরা অভিজাত শ্রেণী। তারা সংখ্যালঘু কার্ডটি ব্যবহার করতে খুব বেশি আগ্রহী। দুর্বল ও উচ্ছেদ হতে যাওয়া লোকজনকে রক্ষায় তাদের কর্মসূচি নেই। বরং সুযোগ হলে দুর্বলদের বলির পাঁঠা হওয়ার বিষয়টি নিজেদের আখের গোছানোর কাজে ব্যবহার করেন এরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন